Type Here to Get Search Results !

দুর্গেশনন্দিনী তৃতীয় ও চতুর্থ খন্ড

      তৃতীয় খন্ড


শৈলেশ্বর-মন্দির হইতে যাত্রা করিয়া জগৎসিংহ পিতৃশিবিরে উপস্থিত হইলে পর, মহারাজ মানসিংহ পুত্প্রমুখাৎ অবগত হইলেন যে, প্রায় পঞ্চাশৎ সহস্র পাঠান নিশীথকালে জগৎসিংহ শৈলেশ্বরের মন্দির হইতে যাত্রা করিলেন। আপাততঃ তীহার অনুগমনে অথবা মন্দিরাধিষ্ঠাত্রী মনোমোহিনীর সংবাদ কথনে পাঠক মহাশয়দিগের কৌতুহল নিবারণ করিতে পারিলাম না। জগৎসিংহ রাজপুত, কি প্রয়োজনে বঙ্গদেশে আসিয়াছিলেন, কেনই বা প্রান্তরমধ্যে একাকী গমন ইতিবৃত্তসম্পকীয়ি। পাঠকবর্গ একান্ত অধীর হইলে ইহা ত্যাগ করিতে পারেন, কিন্তু গরন্থকারের পরামর্শ এই যে, অধৈর্ধ্য ভাল নহে। 

প্রথমে বঙ্গদেশে বখৃতিয়ার খিলিজি মহম্মদীয় জয়ধ্বজা সংস্থাপিত করিলে পর, মুসলমানেরা অবাধে কয়েক শতাব্দী তদ্রীজ্য শাসন করিতে থাকেন । ৯৭২ হেঃ অন্দে সুবিখ্যাত সুলতান বাবর, রণক্ষেত্রে দিল্লীর বাদশাহ ইব্রাহিম লোদীকে পরাভূত করিয়া, তর্থসংহাসনে আরোহণ করেন; কিন্তু তৎকালেই বঙ্গদেশ

তৈমুরলঙ্গবংশীয়দিগের দণ্ডাধীন হয় নাই। যতদিন না মোগল সম্রাটুদিগের কুলতিলক আক্বরের অস্যুদয় হয়, ততদিন এ দেশে স্বাধীন পাঠান রাজগণ রাজত্ব করিতেছিলেন। কুক্ষণে নির্বোধ দাউদ খা
সুপ্ত সিংহের অঙ্গে হস্তক্ষেপণ করিলেন; আত্মকর্মফল আক্বরের সেনাপতি মনাইম খা কর্তৃক পরাজিত হইয়া রাজ্যন্রষ্ট হইলেন। দাউদ ৯৮২ হেঃ অন্দে সগণে উড়িষ্যায় পলায়ন করিলেন; বঙ্গরাজ্য মোগল ভূপালের কর-কবলিত হইল। পাঠানেরা উৎকলে সংস্থাপিত হইলে, তথা হইতে তাহাদিগের উচ্ছেদ করা
মোগলদিগের কষ্টসাধ্য হইল ।

৯৮৬ অন্দে দি্রীশ্বরের প্রতিনিধি খা জীহা খা পাঠানদিগকে দ্বিতীয় বার পরাজিত করিয়া উৎকল দেশ নিজ প্রভুর দণ্তাধীন করিলেন। ইহার পর আর এক দারুণ উপদ্রব উপস্থিত হইয়াছিল । আকবর শাহ কর্তৃক বঙ্গদেশের রাজকর আদায়ের যে নৃতন প্রণালী সংস্থাপিত হইল, তাহাতে জায়গীরদার প্রভৃতি ভূম্যধিকারিগণের গুরুতর অসন্তুষ্টি জন্মিল।

 তীহারা নিজ নিজ পূর্র্বাধিপত্য রক্ষার্থ খড়গহস্ত হইয়া উঠিলেন। অতি দুর্দম্য রাজবিদ্বোহ উপস্থিত হওয়াতে, সময় পাইয়া উড়িষ্যার পাঠানেরা পুনবর্বার মস্তক উন্নত করিল ও কতলু খা নামক এক পাঠানকে আধিপত্যে বরণ করিয়া পুনরপি উড়িষ্যা স্বকরগ্রস্ত করিল। মেদিনীপুরও তাহাদের অধিকারভূক্ত হইল। একজন হিন্দু যোদ্ধা প্রেরিত হইলেন। মহামতি আক্বর তাহার পুর্বগামী সম্রাট্দিগের হইতে সব্ব্বাংশে বিজ্ঞ ছিলেন। তাহার হৃদয়ে বিশেষ প্রতীতি জন্নিয়াছিল যে, এতদ্দেশীয় রাজকার্য্য সম্পাদনে এতদ্দেশীয় লোকই বিশেষ পটু বিদেশীয়েরা তাদৃশ নহে; আর যুদ্ধে বা রাজ্যশীসনে রাজপুতগণ দক্ষাগ্থগণ্য । 

অতএব তিনি সবরবদা এতদ্দেশীয়, বিশেষতঃ রাজপুতগণকে গুরুতর রাজকার্ষ্যে নিযুক্ত করিতেন। আখ্যায়িকাবর্ণিত কালে যে সকল রাজপুত উচ্চপদাভিষিক্ত ছিলেন, তনুধ্যে মানসিংহ একজন প্রধান । তিনি স্বয়ং আক্বরের পুত্র সেলিমের শ্যালক । আজিম খা ও শাহবাজ খা উৎকলজয়ে অক্ষম হইলে, আক্বর এই মহাত্মাকে বঙ্গ ও বেহারের শাসনকর্তা করিয়া পাঠাইলেন। মানসিংহ প্রথমে পাটনায় উপস্থিত হইলে পর, নিজে তন্গরীতে অবস্থিতি করিবার অভিপ্রায় করিয়া বঙ্গপ্রদেশ শাসন জন্য সৈদ খাকে নিজ প্রতিনিধি নিযুক্ত করিলেন। 

সৈদ খা এই ভারপ্রাপ্ত হইয়া বঙ্গদেশের তৎকালিন রাজধানী তণ্ডা নগরে অবস্থিতি করিতেছিলেন। এক্ষণে রণাশায় যাত্রা করিয়া মানসিংহ প্রতিনিধিকে যুদ্ধে আহবান করিলেন । সৈদ খাকে লিখিলেন যে, তিনি বর্ঘমানে তাহার সহিত সসৈন্য মিলিত হইতে চাহেন। বর্ঘমানে উপনীত হইয়া রাজা দেখিলেন যে, সৈদ খা আসেন নাই, কেবলমাত্র দূত দ্বারা এই সংবাদ পাঠাইয়াছেন যে, সৈন্যাদি সংগ্রহ করিতে তাহার বিস্তর বিলম্ব সম্ভাবনা, এমন কি, তীহার সৈন্যসঙ্জা করিয়া যাইতে বর্ধাকাল উপস্থিত হইবে; অতএব রাজা মানসিংহ আপাততঃ বর্ষা শেষ পর্য্যন্ত শিবির সংস্থাপন করিয়া থাকিলে তিনি বর্যাপ্রভাতে সেনা সমভিব্যাহারে রাজসন্নিধানে উপস্থিত হইবেন । রাজা মানসিংহ অগত্যা তৎপরামর্শনুবর্ত হইয়া দারুকেশ্বরতীরে শিবির সংস্থাপিত করিলেন । তথায় সৈদ খাঁর প্রতীক্ষায় রহিলেন। 

আসিয়া দেশ লুঠ করিতেছে। রাজা উদ্ধিগ্রচিত্ত হইয়া, শক্রবল কোথায়, কি অভিপ্রায়ে আসিয়াছে, কি করিতেছে, এই সকল সংবাদ নিশ্চয় জানিবার জন্য তাহার একজন প্রধান সৈন্যাধ্যক্ষকে প্রেরণ করা উচিত বিবেচনা করিলেন। মানসিংহের সহিত তাহার প্রিয়তম পুত্র জগৎসিংহ যুদ্ধে আসিয়াছিলেন। 

জগণ্সংহ এই দুঃসাহসিক কার্য্যের ভার লইতে সোৎসুক জানিয়া, রাজা তাহাকেই শতেক অশ্বারোহী সেনা সমভিব্যাহারে শত্রু শিবিরোদ্দেশে প্রেরণ করিলেন। রাজকুমার কার্য্য সিদ্ধ করিয়া, অচিরাৎ প্রত্যাবর্তন করিলেন যৎকালে কার্য্য সমাধা করিয়া শিবিরে প্রত্যাগমন করিতেছিলেন, তখন প্রান্তরমধ্যে পাঠক মহাশয়ের সহিত তীহার পরিচয় হইয়াছে।


 চতুর্থ খন্ড


সেনা ধরপুর গ্রামের নিকট শিবির সংস্থাপন করিয়া নিকটস্থ গ্রামসকল লুঠ করিতেছে, এবং স্থানে স্থানে দুর্গ নির্মাণ বা অধিকার করিয়া তদাশ্রয়ে এক প্রকার আছে। মানসিংহ দেখিলেন যে, পাঠানদিগের দুবৃত্তির আশু দমন নিতান্ত আবশ্যক হইয়াছে, কিন্তু এই কার্ধ্য অতি দুঃসাধ্য। কর্তব্যাকর্তব্য নিরুপণ জন্য সমভিব্যাহারী সেনাপতিগণকে একত্র করিয়া এই সকল বৃত্তান্ত বিবৃত করিলেন এবং কহিলেন, “দিনে দিনে গ্রাম গ্রাম, পরগণা পরণণা দিলীশ্বরের হস্তম্বলিত

হইতেছে, এক্ষণে পাঠানদিগকে শাসিত না করিলেই নয়, কিন্তু কি প্রকারেই বা তাহাদিগের শাসন হয় £ তাহারা আমাদিগের অপেক্ষা সংখ্যায় বলবান্ঃ তাহাতেআবার দুর্গশ্রেণীর আশ্রয়ে থাকিয়া যুদ্ধ করিবে; যুদ্ধে পরাজিত করিলেও তাহাদিগকে বিনষ্ট বা স্থানচ্যুত করিতে পারিব না; 

সহজেই দুর্ঘমধ্যে নিরাপদ্‌ হইতে পারিবে । কিন্তু সকলে বিবেচনা করিয়া দেখ, যদি রণে আমাদিগকে বিজিত হইতে হয়, তবে শক্রর অধিকারমধ্যে নিরাশ্রয়ে একেবারে বিনষ্ট হইতে হইবে। হইতেছে; সৈদ খাঁর প্রতীক্ষা করাই উচিত হইতেছে; অথচ বৈরিশাসনের আশু কোন উপায় করাও আবশ্যক হইতেছে । তোমরা কি পরামর্শ দাও?

বৃদ্ধ সেনাপতিগণ সকলে একমত হইয়া এই পরামর্শ স্থির করিলেন যে, আপাততঃ সৈদ খার প্রতীক্ষায় থাকাই কর্তব্য। রাজা মানসিংহ কহিলেন, “আমি অভিপ্রায় করিতেছি যে, সমুদায় সৈন্যনাশের সম্ভাবনা না রাখিয়া কেবল অল্পসংখ্যক সেনা কোন দক্ষ সেনাপতির সহিত শক্রসমক্ষে প্রেরণ করি।” একজন প্রাচীন মোগল সৈনিক কহিলেন, “মহারাজ! যথা তাবৎ সেনা পাঠাইতেও আশঙ্কা, তথা অল্পসংখ্যক সেনার দ্বারা কোন্কার্য্য সাধন হইবে £”

কতক দমনে রাখিতে পারিবে ।” তখন মোগল কহিল, “মহারাজ! নিশ্চিত কালগ্রাসে কোন্‌ সেনাপতি যাইবে ?” মানসিংহ ভ্রভঙ্গী করিয়া বলিলেন, কি এত রাজপুত মোগল মধ্যে মৃত্যুকে ভয় কেউ না, এমন কি কেহই নাই ? এই কথা শ্রুতিমাত্র পাঁচ-সাত জন মোগল ও রাজপুত গাব্রোথান করিয়া কহিল, “মহারাজ ! দাসেরা প্রস্তুত আছে।” জগৎসিংহও উপস্থিত ছিলেন; তিনি সবর্বাপেক্ষা বয়ঃকনিষ্ঠ; সকলের পশ্চাতে থাকিয়া কহিলেন, “অনুমতি হইলে এ দাসও দিল্লীস্বরের কার্যসাধনে যত করে ।” 

রাজা মানসিংহ সম্মিতবদনে কহিলেন, “না হবে কেন ? আজ জানিলাম যে, মোগল রাজপুত নাম লোপের বিলম্ব আছে। তোমরা সকলেই এ দুষ্কর কার্ষ্যে প্রস্তুত, এখন কাহাকে রাখিয়া কাহাকে পাঠাই ?” একজন পারিষদ সহাস্যে কহিল, “মহারাজ! যিনি সবর্বাপেক্ষা ক্ষুদ্র সেনা লইয়া যাইতে স্বীকৃত হয়েন, তাহাকেই রাজকার্ধ্য সাধনের ভার দিউন |” রাজা বলিলেন, “এটা উত্তম পরামর্শ ।” প্রথম উদ্যমকারীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কত সংখ্যক সেনা লইয়া যাইতে ইচ্ছা প্রকাশ করো ?” সেনাপতি বললেন, “পঞ্চদশ সহস্র পদাতিবলে রাজকার্ধ্য উদ্ধার করিব ।

” সেনাপতিগণ নীরব হইয়া রহিলেন। পরিশেষে রাজার প্রিয়পাত্র যশোবন্তসিংহ নামক রাজপুত যোদ্ধা রাজাদেশ পালন করিতে অনুমতি প্রার্থিত হইলেন। রাজা হষ্টচিত্তে সকলের প্রতি দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন। কুমার জগৎসিংহ তাহার দৃষ্টির অভিলাষী হইয়া দীড়াইয়া ছিলেন, তৎ্প্রতি রাজার দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত হইবামাত্র তিনি বিনীতভাবে কহিলেন, “মহারাজ! রাজপ্রসাদ হইলে এ দাস পঞ্চ সহস্র সহায়ে কতলু খাকে সুবর্ণরেখাপারে রাখিয়া আইসে!” রাজা মানসিংহ অবাক্‌ হইলেন। 

সেনাপতিগণ কানাকানি করিতে লাগিলেন । ক্ষণেক পরে রাজা কহিলেন, “পুত্র! আমি জানি যে, তুমি রাজপুতকুলের গরিমা; কিন্তু তুমি অন্যায় সাহস করিতেছ!” জগৎসিংহ বদ্ধাঞ্জলি হইয়া কহিলেন, “যদি প্রতিজ্ঞাপালন না করিয়া বাদশাহের সেনাবল অপচয় করি, তবে রাজদণ্ডে দণ্ডনীয় হইব ।” রাজা মানসিংহ কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করিয়া কহিলেন, “আমি তোমার রাজপুতকুলধর্ম প্রতিপালনের ব্যাঘাত করিব না; তুমিই এ কার্্যে যাত্রা কর।” এই বলিয়া রাজকুমারকে বাম্পাকুললোচনে গাঢ় আলিঙ্গন করিয়া বিদায় করিলেন । সেনাপতিগণ স্ব স্ব শিবিরে গেলেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad