Type Here to Get Search Results !

দুর্গেশনন্দিনী - প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড

দুর্গেশনন্দিনী - প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড 



৯৯৭ বঙ্গাব্দের নিদাঘশেষে একদিন একজন অশ্বারোহী পুরুষ বিষুর হইতে মান্দারণের পথে একাকী গমন করিতেছিলেন। দিনমণি অস্তাচলগমনোদ্যোগী দেখিয়া অশ্বারোহী দ্রুতবেগে অশ্ব সঞ্চালন করিতে লাগিলেন। কেন না, সম্মুখে প্রকাণ্ড প্রান্তর; কি জানি, যদি কালধদোষকালে প্রবল ঝটিকা বৃষ্টি আরন্ত হয়, তবে সেই প্রান্তরে, নিরাশ্রয়ে যৎপরোনাস্তি পীড়িত হইতে হইবে। প্রান্তর পার হইতে না হইতেই সূর্যাস্ত হইল; ক্রমে নৈশ গগন নীলনীরদমালায় আবৃত হইতে লাগিল। নিশারন্ এমন ঘোরতর অন্ধকার দিগন্তসংস্থিত হইল যে, অশ্বচালনা অতি কঠিন বোধ হইতে লাগিল। 

পান্থ কেবল বিদ্যুদীপ্তিপ্রদর্শিত পথে কোন মতে চলিতে লাগিলেন। অল্পকাল মধ্যে মহারবে নৈদাঘ ঝটিকা প্রধাবিত হইল, এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রবল বৃষ্টিধারা পড়িতে লাগিল। ঘোটকারঢ ব্যক্তি গন্তব্য পথের আর কিছুমাত্র স্থিরতা পাইলেন না। অশ্ব-বন্না শ্ল্থ করাতে অশ্ব যথেচ্ছ গমন করিতে লাগিল। এইরূপ কিয়দ্দুর গমন করিলে ঘোটকচরণে কোন কঠিন দ্রব্যসংঘাতে ঘোটকের পদঙ্খলন হইল । এ সময়ে একবার বিদ্যুৎ প্রকাশ হওয়াতে পথিক সম্মুখে প্রকাণ্ড ধবলাকার কোন পদার্থ চকিতমাত্র দেখিতে পাইলেন। এঁ ধবলাকার স্তুপ হইবে, এই বিবেচনায় অশ্বীরোহী লাফ দিয়া ভূতলে অবতরণ করিলেন। 

অবতরণমাত্র জানিতে পারিলেন যে, প্রস্তরনির্মিত সোপানাবলীর সংস্রবে ঘোটকের চরণ স্বলিত হইয়াছিল; অতএব নিকটে আশ্রয়-স্থান আছে জানিয়া, অশ্বকে ছাড়িয়া দিলেন। নিজে অন্ধকারে সাবধানে সোপানমার্গে পদক্ষেপ করিতে লাগিলেন । অচিরাৎ তাড়িতালোকে জানিতে পারিলেন যে, সম্মুখস্থ অট্টালিকা এক দেবমন্দির। কৌশলে মন্দিরের ক্ষুদ্র দ্বারে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন যে দ্বার রুদ্ধ; হস্তমার্্জনে জানিলেন, দ্বার বহির্দিক হইতে রুদ্ধ হয় নাই। এই জনহীন প্রান্তরস্থিত মন্দিরে এমন সময়ে কে ভিতর হইতে অর্গল আবদ্ধ করিল, এই চিন্তায় পথিক কিঞ্চিৎ বিস্মিত ও কৌতুহলাবিষ্ট হইলেন । মস্তকোপরি প্রবল বেগে ধারাপাত হইতেছিল, 

সুতরাং যে কোন ব্যক্তি দেবালয়-মধ্য-বাসী হউক, পথিক দ্বারে ভূয়োভূয়ঃ বলদর্পিত করাঘাত করিতে লাগিলেন, কেহই দ্বারোন্মোচন করিতে আসিল না। ইচ্ছা, পদাঘাতে কবাট মুক্ত করেন, কিন্তু দেবালয়ের পাছে অমর্য্যাদা হয়, এই আশঙ্কায় পথিক তত দূর করিলেন না; তথাপি তিনি কবাটে যে দারুণ করপ্রহার করিতেছিলেন, কাষ্ঠের কবাট তাহা অধিকক্ষণ সহিতে পারিল না, অল্পকালেই অর্গলচ্যুত হইল । দ্বার খুলিয়া যাইবামাত্র যুবা যেমন মন্দিরাভ্যন্তরে প্রবেশ করিলেন, অমনই মন্দিরমধ্যে অস্ফুট চীৎকারধ্বনি তাহার কর্ণে প্রবেশ করিল ও তনুহূর্তে মুক্ত দ্বাপথে ঝটিকাবেগ প্রবাহিত হওয়াতে তথা যে ক্ষীণ প্রদীপ জুলিতেছিল, তাহা নিবিয়া গেল। মন্দিরমধ্যে মনুষ্যই বা কে আছে, দেবই বা কি মূর্তি, প্রবেষ্টা তাহার কিছুই দেখিতে পাইলেন না। আপনার অবস্থা এইরূপ দেখিয়া নিভীক যুবা পুরুষ কেবল ঈষৎ হাস্য করিয়া,


ভক্তিভাবে মন্দিরমধ্যস্থ অদৃশ্য দেবমূর্তির উদ্দেশে প্রণাম করিলেন। পরে গাত্রোথান করিয়া অন্ধকারমধ্যে ডাকিয়া কহিলেন, “মন্দিরমধ্যে কে আছ?” কেহই
প্রশ্নের উত্তর করিল না; কিন্তু অলঙ্কারবঙ্কারশব্দ কর্ণে গ্রবেশ করিল। পথিক তখন বৃথা বাক্যব্যয় নিষ্প্রয়োজন বিবেচনা করিয়া বৃষ্টিধারা ও ঝটিকার প্রবেশ
রোধার্থ ধার যোজিত করিলেন, এবং ভগ্নার্গলের পরিবর্তে আত্মশরীর দ্বারে নিবিষ্ট করিয়া পুনবর্বার কহিলেন, “যে কেহ মন্দিরমধ্যে থাক, শ্রবণ কর; এই আমি
সশস্ত্র ্ধাদেশে বসিলাম, আমার বিশ্রামের বিঘ্ন করিও না। বিঘ্ন করিলে, যদি পুরুষ হও, তবে ফলভোগ করিবে; আর যদি স্ত্রীলোক হও, তবে নিশ্চিন্ত হইয়া
নিদ্রা যাও, রাজপুত-হস্তে অসিচর্ঘ্ম থাকিতে তোমাদিগের পদে কুশাঙ্কুরও বিধিবে না।

“আপনি কে ?” বামাস্বরে মন্দিরমধ্য হইতে এই প্রশ্ন হইল। শুনিয়া সবিস্ময়ে পথিক উত্তর করিলেন, “স্বরে বুঝিতেছি, এ প্রশ্ন কোন সুন্দরী করিলেন। আমার
পরিচয়ে আপনার কি হইবে?”

মন্দিরমধ্য হইতে উত্তর হইল, “আমরা বড় ভীত হইয়াছি।”

যুবক তখন কহিলেন, “আমি যেই হই, আমাদিগের আত্মপরিচয় আপনারা দিবার রীতি নাই। কিন্তু আমি উপস্থিত থাকিতে অবলাজাতির কোন প্রকার বিদ্লের
আশঙ্কা নাই।”

রমণী উত্তর করিল, “আপনার কথা শুনিয়া আমার সাহস হইল, এতক্ষণ আমরা ভয়ে মৃতপ্রায় ছিলাম । এখনও আমার সহচরী অর্ধমুচ্ছিতা রহিয়াছেন। আমরা
সায়াহুকালে এই শৈলেশ্বর শিবপূজার জন্য আসিয়াছিলাম । পরে ঝড় আসিলে, আমাদিগের বাহক দাস-দাসীগণ আমাদিগকে ফেলিয়া কোথায় গিয়াছে, বলিতে
পারি না।”

যুবক কহিলেন, “চিন্তা করিবেন না, আপনারা বিশ্রাম করুন, কাল প্রাতে আমি আপনাদিগকে গৃহে রাখিয়া আসিব ।” রমণী কহিল, “শৈলেশ্বর আপনার মঙ্গল
করুন”

অর্রাত্রে ঝটিকা বৃষ্টি নিবারণ হইলে, যুবক কহিলেন, “আপনারা এইখানে কিছুকাল কোনরূপে সাহসে ভর করিয়া থাকুন। আমি একটা প্রদীপ সংগ্রহের জন্য
নিকটবর্তী  যাই ।”

এই কথা শুনিয়া যিনি কথা কহিতেছিলেন, তিনি কহিলেন, “মহাশয়, গ্রাম পর্য্যন্ত যাইতে হইবে না। এই মন্দিরের রক্ষক একজন ভূত্য অতি নিকটেই বসতি
করে; জ্যোতল্সা প্রকাশ হইয়াছে, মন্দিরের বাহির হইতে তাহার কুটার দেখিতে পাইবেন। সে ব্যক্তি একাকী প্রান্তরমধ্যে বাস করিয়া থাকে, এজন্য সে গৃহে
সব্র্বদা অগ্নি জালিবার সামগ্রী রাখে ।”

যুবক এই কথানুসারে মন্দিরের বাহিরে আসিয়া জ্যোতন্নার আলোকে দেবালয়রক্ষকের গৃহ দেখিতে পাইলেন। গৃহদ্বারে গমন করিয়া তাহার নিদ্রাভঙ্গ করিলেন।
মন্দিররক্ষক ভয়্রযুক্ত দ্বারোদ্ঘাটন না করিয়া, প্রথমে অন্তরাল হইতে কে আসিয়াছে দেখিতে লাগিল। বিশেষ পর্যবেক্ষণে পথিকের কোন দস্যুলক্ষণ দৃষ্ট হইল
না; বিশেষতঃ তত্হ্বীকৃত অর্থের লোভ সম্বরণ করা তাহার পক্ষে কষ্টসাধ্য হইয়া উঠিল। সাত পাঁচ ভাবিয়া মন্দিররক্ষক দার খুলিয়া প্রদীপ জ্বালিয়া দিল।

পান্থ প্রদীপ আনিয়া দেখিলেন, মন্দিরমধ্যে শ্বেত-প্রস্তর-নির্মিত শিবমূর্তি স্থাপিত আছে। সেই মূর্তির পশ্চার্ভাগে দুইজন মাত্র কামিনী । যিনি নবীনা, তিনি দীপ
দেখিবামাত্র সাবগুষ্ঠনে নত্রমুখী হইয়া বসিলেন। পরন্তু তাহার অনাবৃত প্রকোষ্ঠে হীরকমগ্ডিত চূড় এবং বিচিত্র কারুকার্য্যখচিত পরিচ্ছদ. তদুপরি
রত্বাভরণপারিপাট্য দেখিয়া পান্থ নিঃসন্দেহে জানিতে পারিলেন যে, এই নবীনা হীনবংশসন্ভৃতা নহে। দ্বিতীয়া রমণীর পরিচ্ছদের অপেক্ষাকৃত হীনার্ঘতায় পথিক
বিবেচনা করিলেন যে, ইনি নবীনার সহচারিণী দাসী হইবেন; অথচ সচরাচর দাসীর অপেক্ষা সম্পন্না। বয়ঃক্রম পঞ্চত্রিংশৎ বর্ষ বোধ হইল । 



দ্বিতীয় খণ্ড     



পুরুষের উপলব্ধি হইল যে, বয়োজ্যেষ্ঠারই সহিত তাহার কথোপকথন হইতেছিল। তিনি সবিম্ময়ে ইহাও পর্য্যবেক্ষণ করিলেন যে, তদুভয় মধ্যে কাহারও পরিচ্ছদ
এতদেশীয় স্ত্রীলোকদিগের ন্যায় নহে, উভয়েই পশ্চিমদেশীয়, অর্থাৎ হিন্দুস্থানী স্ত্রীলোকের বেশধারিণী । যুবক মন্দিরাভ্যন্তরে উপযুক্ত স্থানে প্রদীপ স্থাপন করিয়া
রমণীদিগের সম্মুখে দীড়াইলেন। তখন তাহার শরীরোপরি দীপরশ্বি-সমূহ প্রপতিত হইলে, রমণীরা দেখিলেন যে, পথিকের বয়ঃক্রম পঞ্চবিংশতি বৎসরের
কিঞ্িন্মাত্র অধিক হইবে; শরীর এতাদৃশ দীর্ঘ যে অন্যের তাদৃশ দৈর্ঘ্য অসৌষ্ঠবের কারণ হইত। কিন্তু যুবকের বক্ষোবিশালতা এবং সব্বা্গের প্রচুরায়ত
গঠনগুণে সে দৈঘ্্ অলৌকিক শ্রীসম্পাদক হইয়াছে। প্রাবৃটসন্ভৃত নবদুবর্বাদলতুল্য, অথবা তদধিক মনোজ্ঞ কান্তি; বসন্তপ্রসূত নবপত্রাবলীতুল্য বর্ণোপরি কবচাদি
রাজপুত জাতির পরিচ্ছদ শোভা করিতেছিল, কটিদেশে কটিবন্ধে কোষসন্বন্ধ অসি, দীর্ঘ করে দীর্ঘ বর্শা ছিল; মস্তকে উষ্ভীষ, তদুপরি একখণ্ড হীরক; কর্ণে
মুক্তাসহিত কুগুল; কণ্ঠে র্রহার।

পরস্পর সন্দর্শনে উভয় পক্ষই পরস্পরের পরিচয়ের জন্য বিশেষ ব্যগ্ধ হইলেন, কিন্তু কেহই প্রথমে পরিচয় জিজ্ঞাসার অভ্দ্রতা স্বীকার করিতে সহসা ইচ্ছুক
হইলেন না।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদঃ আলাপ

প্রথমে যুবক নিজ কৌতুহলপরবশতা প্রকাশ করিলেন। বয়োজ্যেষ্ঠাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “অনুভবে বুঝিতেছি, আপনারা ভাগ্যবানের পুরস্তী, পরিচয়
জিজ্ঞাসা করিতে সঙ্কোচ হইতেছে; কিন্তু আমার পরিচয় দেওয়ার পক্ষে যে প্রতিবন্ধক, আপনাদের সে প্রতিবন্ধক না থাকিতে পারে, এজন্য জিজ্ঞাসা করিতে
সাহস করিতেছি।”

জ্যেষ্ঠা কহিলেন, “স্ত্রীলোকের পরিচয়ই বা কি? যাহারা কুলোপাধি ধারণ করিতে পারে না, তাহারা কি বলিয়া পরিচয় দিবে? গোপনে বাস করা যাহাদিগের ধর্ম,
তাহারা কি বলিয়া আত্মপ্রকাশ করিবে ? যে দিন বিধাতা স্ত্রীলোককে স্বামীর নাম মুখে আনিতে নিষেধ করিয়াছেন, সেই দিন আত্মপরিচয়ের পথও বন্ধ
করিয়াছেন।”

যুবক এ কথার উত্তর করিলেন না। তাহার মন অন্য দিকে ছিল। নবীনা রমণী ক্রমে ক্রমে অবগুগ্ঠনের কিয়দংশ অপসৃত করিয়া সহচরীর পশ্চান্তাগ হইতে
অনিমেষচক্ষুতে যুবকের প্রতি দৃষ্টি করিতেছিলেন। কথোপকথন মধ্যে অকম্মাৎ পথিকেরও সেই দিকে দৃষ্টিপাত হইল; আর দৃষ্টি ফিরিল না; তাহার বোধ হইল,
যেন তাদৃশ অলৌকিক রূপরাশি আর কখন দেখিতে পাইবেন না। যুবতীর চক্ষুর্ঘয়ের সহিত পথিকের চক্ষু সংমিলিত হইল । যুবতী অমনি লোচনযুগল বিনত
করিলেন। সহচরী বাক্যের উত্তর না পাইয়া পথিকের মুখপানে চাহিলেন। কোন্‌ দিকে তাহার দৃষ্টি, তাহাও নিরীক্ষণ করিলেন, এবং সমভিব্যাহারিণী যে যুবক
প্রতি সতৃষ্ণনয়নে চাহিতেছিলেন, তাহা জানিতে পারিয়া, নবীনার কানে কানে কহিলেন, “কি লো! শিবসাক্ষাৎ স্বয়ন্বরা হবি না কি?”

নবীনা, সহচরীকে অঙ্গুলিনিগীড়িত করিয়া তদ্রুপ মৃদুস্বরে কহিল, “তুমি নিপাত যাও ।” চতুরা সহচারিণী এই দেখিয়া মনে মনে ভাবিলেন যে, যে লক্ষণ
দেখিতেছি, পাছে এই অপরিচিত যুবা পুরুষের তেজঃপুঞ্জ কান্তি দেখিয়া আমার হস্তসমর্সিতা এই বালিকা মন্মথশরজালে বিদ্ধ হয়; তবে আর কিছু হউক না
হউক, ইহার মনের সুখ চিরকালের জন্য নষ্ট হইবে, অতএব সে পথ এখনই রুদ্ধ করা আবশ্যক । কিরূপেই বা এ অভিপ্রায় সিদ্ধ হয়? যদি ইঙ্গিতে বা
ছলনাক্রমে যুবককে স্থানান্তরে প্রেরণ করিতে পারি, তবে তাহা কর্তব্য বটে, এই ভাবিয়া নারী-স্বভাবসিদ্ধ চতুরতার সহিত কহিলেন, “মহাশয়! স্ত্রীলোকের সুনাম
এমনই অপদার্থ বস্তু যে, বাতাসের ভর সহে না । আজিকার এ প্রবল ঝড়ে রক্ষা পাওয়া দুঙ্কর, অতএব এক্ষণে ঝড় থামিয়াছে, দেখি যদি আমরা পদ্বজে বাটী ।


গমন করিতে পারি ।”

যুবা পুরুষ উত্তর করিলেন, “যদি একান্ত এ নিশীথে আপনারা পদ্ব্রজে যাইবেন, তবে আমি আপনাদিগকে রাখিয়া আসিতেছি। এক্ষণে আকাশ পরিষ্কার
হইয়াছে, আমি এতক্ষণ নিজস্থানে যাত্রা করিতাম, কিন্তু আপনার সথীর সদৃশ রূপসীকে বিনা রক্ষকে রাখিয়া যাইব না বলিয়াই এখন এ স্থানে আছি।”

কামিনী উত্তর করিল, “আপনি আমাদিগের প্রতি যেরূপ দয়া প্রকাশ করিতেছেন, তাহাতে পাছে আমাদিগকে অকৃতজ্ঞ মনে করেন, এজন্যই সকল কথা ব্যক্ত
করিয়া বলিতে পারিতেছি না। মহাশয়! স্ত্রীলোকের মন্দ কপালের কথা আপনার সাক্ষাতে আর কি বলিব। আমরা সহজে অবিশ্বীসিনী; আপনি আমাদিগকে
রাখিয়া আসিলে আমাদিগের সৌভাগ্য, কিন্তু যখন আমার প্রভূ__এই কন্যার পিতা_ ইহাকে জিজ্ঞাসা করিবেন, তুমি এ রাত্রে কাহার সঙ্গে আসিয়াছ, তখন ইনি
কি উত্তর করিবেন £”

যুবক ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া কহিলেন, “এই উত্তর করিবেন যে, আমি মহারাজ মানসিংহের পুত্র জগৎসিংহের সঙ্গে আসিয়াছি।”

যদি তনুহূর্তে মন্দিরমধ্যে বজ্রপতন হইত, তাহা হইলেও মন্দিরবাসিনী স্ত্রীলোকেরা অধিকতর চমকিত হইয়া উঠিতেন না। উভয়েই অমনি গাত্রোথান করিয়া
দণ্ডায়মান হইলেন । কনিষ্ঠা শিবলিঙ্গের পশ্চাতে সরিয়া গেলেন। বাগ্বিদগ্ধা বয়োধিকা গলদেশে অঞ্চল দিয়া দণ্তবৎ হইলেন; অঞ্জলিবদ্ধকরে কহিলেন, “যুবরাজ!
না জানিয়া সহস্র অপরাধ করিয়াছি, অবোধ স্ত্রীলোকদিগকে নিজপুণে মার্জনা করিবেন ।”

যুবরাজ হাসিয়া কহিলেন, “এ সকল গুরুতর অপরাধের ক্ষমা নাই । তবে ক্ষমা করি, যদি পরিচয় দাও, পরিচয় না দিলে অবশ্য সমুচিত দণ্ড দিব ।”

নরম কথায় রসিকার সকল সময়েই সাহস হয়; রমণী ঈষৎ হাসিয়া কহিল, “কি দণ্ড, আজ্ঞা হউক, স্বীকৃত আছি।”

জগৎসিংহ হাসিয়া কহিলেন, “সঙ্গে গিয়া তোমাদের বাটা রাখিয়া আসিব।”

সহচরী দেখিলেন, বিষম সঙ্কট । কোন বিশেষ কারণে তিনি নবীনার পরিচয় দিল্লীশ্বরের সেনাপতির নিকট দিতে সম্মতা ছিলেন না; তিনি যে তাহাদিগকে সঙ্গে
করিয়া রাখিয়া আসিবেন, ইহাতে আরও ক্ষতি, সে ত পরিচয়ের অধিক; অতএব সহচরী অধোবদনে রহিলেন।

এমন সময়ে মন্দিরের অনতিদূরে বহুতর অশ্থের পদধ্বনি হইল; রাজপুত্র অতি ব্যস্ত হইয়া মন্দিরের বাহিরে যাইয়া দেখিলেন যে, প্রায় শত অশ্বারোহী সৈন্য
যাইতেছে। তাহাদিগের পরিচ্ছদ দৃষ্টিমাত্র জানিতে পারিলেন যে, তাহারা তাহারই রাজপুত সেনা। ইতিপূর্বে যুবরাজ যুদ্ধসন্বন্ীয় কার্য্য সম্পাদনে বিষ্ণুপুর
অঞ্চলে যাইয়া, ত্বরিত একশত অশ্বারোহী সেনা লইয়া পিতৃসমক্ষে যাইতেছিলেন। অপরাহে সমভিব্যাহারিগণের অগ্রসর হইয়া আসিয়াছেন; পশ্চাৎ তাহারা এক
পথে, তিনি অন্য পথে যাওয়াতে, তিনি একাকী প্রান্তরমধ্যে ঝটিকা বৃষ্টিতে বিপদ্ধস্ত হইয়াছিলেন। এক্ষণে তাহাদিগকে পুনবর্বার দেখিতে পাইলেন, এবং
সেনাগণ তাহাকে দেখিতে পাইয়াছে কি না, জানিবার জন্য কহিলেন, “দিন্রীশ্বরের জয় হউক ।” এই কথা কহিবামাত্র একজন অশ্বীরোহী তাহার নিকট আসিল।
যুবরাজ তাহাকে দেখিয়া কহিলেন, “ধরমসিংহ, আমি ঝড় বৃষ্টির কারণে এখানে অপেক্ষা করিতেছিলাম।”

ধরমসিংহ নতভাবে প্রণাম করিয়া কহিল, “আমরা যুবরাজের বহু অনুসন্ধান করিয়া এখানে আসিয়াছি, অশ্বকে এই বটবৃক্ষের নিকটে পাইয়া আনিয়াছি।”
জগৎসিংহ বলিলেন, “অশ্ব লইয়া তুমি এইখানে অপেক্ষা কর, আর দুইজনকে নিকটস্থ কোন গ্রাম হইতে শিবিকা ও তদুপযুক্ত বাহক আনিতে পাঠাও, অবশিষ্ট
সেনাগণকে অগ্রসর হইতে বল।”

ধরমসিংহ এই আদেশ প্রাপ্ত হইয়া কিঞ্ৎ বিস্মিত হইল, কিন্তু প্রভূর আজ্ঞায় প্রশ্ন অনাবশ্যক জানিয়া, যে আজ্ঞা বলিয়া সৈন্যদিগকে যুবরাজের অভিপ্রায়
জানাইল। সৈন্যমধ্যে কেহ কেহ শিবিকার বার্ত শুনিয়া ঈষৎ হাস্য করিয়া অপরকে কহিল,, “আজ যে বড় নৃতন পদ্ধতি ।” কেহ বা উত্তর করিল, “না হবে কেন?


মহারাজ রাজপুতপতির শত শত মহিষী ।”

এদিকে যুবরাজের অনুপস্থিতিকালে অবসর পাইয়া অবগুগ্ঠন মোচনপুর্বক সুন্দরী সহচরীকে কহিল, “বিমল, রাজপুত্রকে পরিচয় দিতে তুমি অসম্মত কেন ?”
বিমলা কহিল, “সে কথার উত্তর আমি তোমার পিতার কাছে দিব; এক্ষণে আবার এ কিসের গোলযোগ শুনিতে পাই £”

নবীনা কহিল, “বোধ করি, রাজপুত্রের কোন সৈন্যাদি তাহার অনুসন্ধানে আসিয়া থাকিবে; যেখানে স্বয়ং যুবরাজ রহিয়াছেন, সেখানে চিন্তা কর কেন ?

যে অশ্বারোহিগণ শিবিকাবাহকাদির অবেষণে গমন করিয়াছিল, তাহারা প্রত্যাগমন করিবার পূর্বেই, যে বাহক ও রক্ষিবর্গ স্ত্রীদিগকে রাখিয়া বৃষ্টির সময়ে
গ্রামমধ্যে গিয়া আশ্রয় লইয়াছিল, তাহারা ফিরিয়া আসিল। দূর হইতে তাহাদিগকে দেখিয়া জগৎসিংহ মন্দিরমধ্যে পুনঃপবেশপুবর্বক পরিচারিকাকে কহিলেন,
“কয়েকজন অস্ত্রধারী ব্যক্তির সহিত বাহকগণ শিবিকা লইয়া আসিতেছে, উহারা তোমাদিগের লোক কি না, বাহিরে আসিয়া দেখ ।” বিমলা মন্দিরদ্বারে দীড়াইয়া
দেখিল যে, তাহারা তাহাদিগের রক্ষিগণ বটে ।

রাজকুমার কহিলেন, “তবে আমি আর এখানে দীড়াইব না; আমার সহিত ইহাদিগের সাক্ষাতে অনিষ্ট ঘটিতে পারে । অতএব আমি চলিলাম। শৈলেশ্বরের
নিকটে প্রার্থনা করি, তোমরা নিরির্বঘ্নে বাটী উপনীত হও; তোমাদিগের নিকট এই প্রার্থনা করি যে, আমার সহিত সাক্ষাৎ হইয়াছিল, এ কথা সপ্তাহমধ্যে প্রকাশ
করিও না; বিশ্থৃত হইও না, বরং স্মরণার্থ এই সামান্য বস্তু নিকটে রাখ । আর আমি তোমার প্রভুকন্যার যে পরিচয় পাইলাম না, এই কথাই আমার হৃদয়ে
স্মরণার্থ চিহ্স্বরূপ রহিল ।” এই বলিয়া উদ্তীষ হইতে মুক্তাহার লইয়া বিমলার মস্তকে স্থাপন করিলেন। বিমলা মহার্ঘ রক্রহার কেশপাশে ধরিয়া রাজকুমারকে
বিনীতভাবে প্রণাম করিয়া কহিল, “যুবরাজ, আমি যে পরিচয় দিলাম না, ইহাতে আমাকে অপরাধিনী ভাবিবেন না, ইহার অবশ্য উপযুক্ত কারণ আছে। যদি
আপনি এ বিষয়ে নিতান্ত কৌতুহলাত্রান্ত হইয়া থাকেন, তবে অদ্য হইতে পক্ষান্তরে আপনার সহিত কোথায় সাক্ষাৎ হইতে পারিবে, বলিয়া দিন।”

জগৎসিংহ কিয়ৎকাল চিন্তা করিয়া কহিলেন, “অদ্য হইতে পক্ষান্তরে রাত্রিকালে এই মন্দির মধ্যেই আমার সাক্ষাৎ পাইবে । এই স্থলে দেখা না পাও_ সাক্ষাৎ
হইল না।”

“দেবতা আপনাকে রক্ষা করুন” বলিয়া বিমলা পুনব্ব্বার প্রণতা হইল । রাজকুমার পুনবর্বার অনিবার্য তৃষ্ঠাকাতর লোচনে যুবতীর প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া, লক্ষ
দিয়া অশ্বারোহণপুবর্বক চলিয়া গেলেন।







একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad